Wednesday, July 2, 2014

ফরমালিনের কারণে গর্ভস্থ শিশু হবে বিকলাঙ্গ

ঢাকা, জুলাই ০২: ফরমালিন একধরনের বিষ। ফরমালিনের বিশেষ কোনো সহনীয় মাত্রা নেই। যে কোনো মাত্রার বিষই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি ক্যান্সারসহ জটিল রোগের জন্মদাতা। নারীর শরীরের জন্য ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাব আরো মারাত্মক। তাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে ঋতুস্রাবে সমস্যা হয়। ফরমালিনের কারণে গর্ভস্থ শিশু হতে পারে বিকলাঙ্গ।

ফরমালিনের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এসব ভয়ংকর কথা।

ফরমালিন নিয়ে কথা বলেছে বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক, ঢাবি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নিলুফার নাহার, ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাসিমা খানের সঙ্গে।

তারা জানান, ফরমালিন একটি বিষ, এর কোনো সহনীয় মাত্রা নেই। যে কোনো মাত্রার ফরমালিনেই শরীরের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। যারা ফরমালিনের সহনীয় মাত্রার কথা বলেন তারা ঘটনার গভীরে না গিয়েই বলেন।

ড. আ ব ম ফারুক বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্যান্সার রিসার্চ বলছে, খাদ্যদ্রব্যে যদি ২ পিপিবি (১০০কোটি ভাগের দু’ভাগ) মাত্রার ফরমালিনও থাকে তবে তাও শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিমাণ এত অল্প যা ল্যাবরেটরিতেও মাপা দুঃসাধ্য। তাহলে সহনীয় মাত্রার প্রশ্ন আসে কীভাবে!

বিশিষ্ট ওষুধ প্রযুক্তিবিদ আ ব ম ফারুকের ফরমালিন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণার অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

এত অল্প মাত্রার ফরমালিন কীভাবে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। বলেন, ফরমালিন বা ফরমাল্ডিহাইড শরীরের নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ)’র গঠন বদলে ফেলে। এটা খুবই বিক্রিয়াশীল। এটা শরীরের যে কোনো একটি ডিএনএ’র গঠন বদলে দিলেই ওটা ক্যান্সারাস হয়ে যায়। ওই ডিএনএটি সারা শরীরে ঘুরে বেড়ায়। এরপর যেখানেই আটকে যায় সেখানেই এটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। লিভারে আটকালে হয় লিভার ক্যান্সার, মস্তিষ্ক আটকালে হয় ব্রেন ক্যান্সার। মোটকথা যেখানেই আটকায় সেখানেই ক্যান্সার সৃষ্টি করে।

তবে ফরমালিনের সহনীয় মাত্রা না থাকলেও ফুড কালার, প্রিজারভেটিভ, টেস্টিং সল্ট প্রভৃতির সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব বলে জানান তিনি।

ফরমালিন পরিমাপক যন্ত্র নিয়ে ওঠা বিতর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়টাকে বিতর্ক না বলে কুতর্ক বলি। আমার জানা দরকার ফলে ফরমালিন আছে কি নেই। কত মাত্রার আছে সেটার সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করতে হলেতো ল্যাবে যেতে হবে। সুতরাং, এ মেশিন দিয়ে যেহেতু মাপা যায় ফরমালিন আছে কি নেই, এটুকুইতো যথেষ্ট।

প্রাকৃতিকভাবেই ফলমূলে কিছু ফরমালিনের উপাদান থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে ফরমালিনের এ উপাদান ল্যাবে কেমিক্যাল টেস্ট ছাড়া পরিমাপ করা সম্ভব নয় এবং প্রয়োজনও নেই। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

কিন্তু সাধারণ মেশিন বা কিটো টেস্টে ফরমালিনের যে উপস্থিতি ধরা পড়ে তা বাহ্যিকভাবে মেশানো হয়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান বিশিষ্ট এ ওষুধ প্রযুক্তিবিদ।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে অধ্যাপক ফারুক আরও বলেন, ফরমালিন খাদ্য পরিপাকে বাধা দেয়, পাকস্থলীর ক্ষতি করে, লিভারের এনজাইমগুলো নষ্ট করে এবং কিডনির কোষ নেফ্রনগুলো ধ্বংস করে। ফলে গ্যাস্ট্রিক ও আলসার বাড়ে, কিডনি ও লিভারে বিভিন্ন জটিল ও দূরারোগ্য রোগ সৃষ্টি হয়।

নারীদের শরীরে ফরমালিনের ক্ষতিকর প্রভাবও মারাত্মক। তাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করলে নিয়মিত ঋতু্স্রাবে সমস্যা হয়। ফরমালিনের কারণে গর্ভস্থ শিশু বিকলাঙ্গ হয় বলেও গবেষকরা প্রমাণ করেছেন।

সুতরাং, যতদ্রুত সম্ভব এই ভয়াবহ উপদ্রব থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি মিডিয়া ও সাধারণ ভোক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মত দেন অধ্যাপক ফারুক।

অধ্যাপক ফারুক আরো বলেন, ফরমালিন নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে যে সচেতনা তৈরি হয়েছে এটি অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যবসায়ীরা এটিকে ভালোভাবে দেখছেন না। তবে সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নিলুফার নাহার বলেন, ফরমালিন কোনো খাবার জিনিস নয়, এটি কেমিক্যাল, এটি একটি ‘বিষ’। মানবদেহে ঢোকার কোনো প্রশ্নই আসে না। বিষের কোনো সহনীয় মাত্রা হতে পারে না। ফরমালিনের ‘সহনীয়’ মাত্রা দশমিক ১২৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) বলতে ১০ লাখ লিটার পানির সঙ্গে ১৫ লিটার ফরমালিনের মিশ্রণকে বোঝায়।

ঢামেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুদীপ রঞ্জন দেব বাংলানিউজকে বলেন, চুলার তাপে খাবারে ব্যবহৃত যে কোনো কেমিক্যালের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তবে ফরমালিন এতটাই ভয়াবহ যে কোনোভাবেই এর কার্যকারিতা নষ্ট করা যায় না।

ফরমালিনের অন্যতম উপাদান ফরম্যালডিহাইডের কারণে মানবদেহে ক্যারসিনোজেন বা ক্যান্সারের সহায়ক। ফরমালিন দীর্ঘ মেয়াদে হার্ট, লিভার, ফুসফুস অথবা ব্রেন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এমনকি কিডনির জটিলতম রোগেরও উৎস এই ফরম্যালডিহাইড বলে জানান সুদীপ রঞ্জন।

ডা. সুদীপ বলেন, প্রতিনিয়ত মায়েদের ফরমালিন খাওয়ার কারণে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে, দাঁত উঠতে দেরি হবে, হাড়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেবে এবং অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বিকলাঙ্গও হয়ে যেতে পারে।

শুধু ফরমালিন খেলেই নয়, যারা হাত দিয়ে ফরমালিন মেশায়, ফরমালিন নিয়ে নাড়াচাড়া করে তাদেরও চর্ম এলার্জি, শ্বাসকষ্ট এও অ্যাজমা হতে পারে।

তাই দেশকে ফরমালিনের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত করতে সরকারসহ দেশের সব মানুষকে একজোট হয়ে কাজ করার আহ্ববান জানালেন রসায়নবিদেরা।

তবে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সহনীয় মাত্রার কথা বললেও সরকারিভাবে স্বীকৃত কোনো মাত্রা এখনো নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাসিমা খান।
তিনি বলেন, মানবদেহের বাহ্যিক চামড়া থেকে হৃদপিন্ড (হার্ট) পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গে ফরমালিনের ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। 


শেয়ারনিউজ২৪/এফএম/১৩২০ঘ.

No comments:

Post a Comment