গরুর নামে মহিষের মাংস-৩
রাতের মহিষ দিনে গরু, বিক্রি
হয় রক্তও
মুনিফ আম্মার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলামেইল২৪ডটকম
‘মাংস কী গরুর না মহিষের’ এমন
প্রশ্ন দোকানীকে করলে এককথায় উত্তর ‘নির্ভেজাল গরুর মাংস’। আর সাধারণ মানুষ বলেন ‘ঢাকায় সবই মহিষের মাংস, বিক্রি
হচ্ছে গরুর নামে’। দ্বিমুখি উত্তরে দ্বিধা বাড়ে, আরো
প্রশ্ন জাগে। কিন্তু
প্রমাণ পাওয়া যায় না কোথাও। কেউ জানাতে পারেন না, মহিষ থেকে গরুর মাংস হওয়ার মূল ঘটনা। তাহলে রহস্য কোথায়? বাংলামেইলের
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ঢাকায় কোত্থেকে আমদানি হয় মহিষ, কোথায়
জবাই হয় এগুলো আবার কোথা থেকে বেরিয়ে আসে ‘নির্ভেজাল’ গরুর মাংস হয়ে। তিন পর্বের এ প্রতিবেদনটি সাজানো হয়েছে ‘মহিষ
থেকে গরুর মাংস’ হওয়ার আদ্যোপান্ত নিয়ে। সেই সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে ‘কেঁচু
খুঁড়তে গিয়ে সাপ পাওয়ার’ মতো চমকে যাওয়া অনেক তথ্য। আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব। লিখেছেন বাংলামেইলের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মুনিফ আম্মার।
ঢাকা: রাতভর মহিষ নিয়ে বিস্তর আয়োজন চলে কসাইখানাগুলোতে। জবাইয়ের পর মহিষের কোনো অংশই ফেলনা নয় তাদের
কাছে। পা থেকে জিভ কিংবা নাড়িভূড়িও
বিক্রি করেন তারা। অংশ
ভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয় ওসব। তবে কসাইদের মূল টার্গেট থাকে মহিষের মাংসকে গরুর মাংসে রূপান্তরিত করা। কাজটা তাদের কাছে খুব কঠিন কিছুও নয়। কেবল দিনের আলো ফোটার আগেই কসাইখানা থেকে সরিয়ে
ফেলতে হয় মহিষের চামড়া, মাথা আর পায়ের অংশটুকু। কেটে রাখা বাকি অংশ দেখে সহজে কারও বোঝার উপায়
থাকে না, এসব আসলে কিসের মাংস।
বিক্রিতেই পাল্টে যায় নাম
রাতভর
জবাই হওয়া মহিষের মাংস মূলত বিক্রি শুরু হয় ভোর থেকে। কসাইখানাগুলো থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার
খুচরা মাংস বিক্রেতারা কিনে নেয় এসব। পাশাপাশি ওখানেও চলে দিনভর খুচরা বিক্রি। তবে সবাই মহিষের এসব মাংসকে গরু বলেই বিক্রি
করেন। বিক্রেতা সেজে পাইকারি ও
খুচরা একাধিক দোকানে খোঁজ নিয়ে মিলেছে এর সত্যতা।
তবে বিক্রি শুরুর আগেই কসাইখানায় রাতের চিত্র পাল্টে ফেলা হয়। ধুয়ে মুছে অনেকটা পরিস্কার করা হয় চারপাশ। মহিষের সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলা হয় আশপাশ থেকে। ভোর ৫টার আগেই সারা হয়ে যায় এসব।
সাড়ে ৫টার দিকে একে একে পাইকারি ক্রেতারা ভিড়তে থাকে কসাইখানায়। সিএনজি, রিকশা আর ভ্যানগাড়ি করে দোকানে দোকানে নিয়ে যায়
মাংস। গুলশান ডিসিসি মার্কেটের
জাহাঙ্গীর, নিউ মার্কেটের সোলেমান, আজিমপুরের বাবু,
বাংলামোটরের নুরুন্নবী আর এলিফ্যান্ট রোডের
ওলিসহ অনেকেই কাওরান বাজারের নিয়মিত ক্রেতা। মহিষের মাংস নিয়ে তাদের দোকানে সেটা গরু বলে চালিয়ে দেন
অনায়াসে। বিক্রির সময় মহিষের নাম
পাল্টে হয়ে যায় গরু।
‘মহিষ না, ইন্ডিয়ান বড় গরু’
‘স্যার, ভালো মাংস। নিতে পারেন। মহিষের মাংস বেচি না। এইগুলা ইন্ডিয়ান বড় গরুর মাংস।’ এভাবেই
এক ক্রেতাকে আশ্বস্ত করতে দেখা গেছে গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেটের ৩নং মাংসের
দোকানদার জাহাঙ্গীরকে। সাত
সকালেই ‘মিথ্যা’ বলে তিনি ক্রেতাদের কাছে টানছেন। ভোর সাড়ে ৬টায় কারওয়ান বাজার থেকে কেনা মহিষের
মাংস মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে সাড়ে ৭টায় বিক্রি করছেন ইন্ডিয়ান বড় গরু বলে।
তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে খানিকটা বিব্রত হন। মুহূর্তেই সেটা কাটিয়ে উঠে বলেন, ‘পরিচিত
মানুষের কাছে তো আর বেচি না। পরিচিতদের কাছে মহিষ বইলাই বিক্রি করি। আর অপরিচিতরা আইলে ইন্ডিয়ান গরু বইলা চালাইয়া দেই।’
একই দৃশ্য দেখা গেছে বাংলামোটরের মাংস বিক্রেতা নুরুন্নবীর দোকানে। কাওরান বাজার থেকে তিনি কিনেছেন দুইশ কেজি
মহিষের মাংস। দোকানে
এনেই সেগুলোকে গরুর নামে সাজিয়েছেন। একের পর এক ক্রেতারা এসে সেগুলো কিনছে ‘খাঁটি’ গরুর মাংস হিসেবেই।
বিক্রি হয় মহিষের ‘রক্তও’
কেবলই মাংস নয়, বোতলে বোতলে বিক্রি হয় জবাই করা মহিষের রক্ত। কারা কেনে এসব?
প্রশ্ন জাগতে পারে। সে উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা
বিক্রেতারাই এ রক্তের ক্রেতা। পঁচা, দুর্গন্ধময় আর অস্বাস্থ্যকর এ রক্ত দিয়ে কী হয় সেটা খুঁজতে
গিয়ে আঁতকে উঠতে হবে।
একশ ৭৫ কেজি মহিষের মাংস কিনেছেন আজিমপুর কবরস্থানের পাশের খুচরা ব্যবসায়ী
বাবু। সঙ্গে তিনি ৩০ টাকা দিয়ে দুই
লিটারের একবোতল রক্ত কিনেছেন। তার কাছেই জানা গেছে, সকাল থেকে ঝুলিয়ে রাখা মাংসগুলো বিকেলের দিকে অনেকটা শুকিয়ে
যাবে। তখন এ মাংসকে তাজা করতে মাখানো
হবে এসব রক্ত।
ক্রেতাদের চোখে ধুলো দেয়ার কাজে ব্যবহৃত এ রক্ত কিনেছেন অন্যান্য খুচরা বিক্রেতারাও। এলিফ্যান্ট রোডের খুচরা ব্যবসায়ী নুরুন্নবী
নিয়মিত মাংস কেনেন কাওরান বাজারের শহীদ মহাজনের কাছ থেকে। প্রতিদিনই মাংসের সঙ্গে রক্তও কেনেন তিনি। তবে রক্ত মাখানো মাংস মানবদেহের জন্য কতোখানি
ক্ষতিকর সে বিষয়ে ভাবার কোনো সময় নেই তার। বাংলামেইলকে তিনি বলেন, ‘মাংস বেইচ্যা কূল পাই না। এতোকিছু চিন্তা করুম কোন সময়? আর
মাংসে রক্ত দিলে ক্ষতি হইবো ক্যান?’
তবে এ বিষয়ে বারডেমের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেলী সাত্তার বাংলামেইলকে বলেন, ‘এটাতো
খুবই ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার। এমনিতেই রক্ত খাওয়ার জিনিস না। তার উপর জমাট বাঁধা কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে রাখা রক্ত যদি মাংসে মাখানো হয়, তাহলে
তার থেকে অনেক জীবানু ছড়াতে পারে। এজন্য মানুষের লিভার, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সবাইকে এসব থেকে সাবধানে থাকা উচিৎ।’
মহিষের মাংস যাচ্ছে ‘নামিদামি’ রেস্টুরেন্টেও
কেবলই কি খুচরা বিক্রি? গরুর নামে বিক্রি এসব মহিষের মাংস প্রতিদিনই
যাচ্ছে রাজধানীর ‘নামিদামি’ অনেক হোটেল রেস্টুরেন্টে। এমনকি দেশ সেরা হোটেল প্যান প্যাসেফিক
সোনারগাঁওয়েও এ মাংস যায় বলে জানা গেছে কসাইদের কাছ থেকে।
কসাই
হাজী টিপু সুলতান বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাগো মাংস কে নেয় না? সোনারগাঁ
থেইক্যা আইসাও মাংস লইয়া যায়। স্টার কাবাবের কিমা বানায় আমাগো মাংস দিয়াই। ফখরুদ্দিনও কিমার লাইগ্যা আমাগো মাংস নেয়।’
কসাই হযরত আলী বলেন, ‘ঢাকার অন্তত ৪০টি হোটেলে আমাগো মাংস যায়। নীলক্ষেত ধানমণ্ডির সব বিরানীর দোকানে এ মাংস
দিয়াই বিরানী হয়। সোনারগাঁ
হোটেলে রেন্ডি কাবাব বানায় এ মাংস দিয়া। কোনটার কথা বাদ দেবেন? সবখানেই গরুর নাম কইরা মাহিষের মাংসই বেচে।’
কসাইদের এ কথার সত্যতা খুঁজতে কাওরান বাজারের স্টার কাবাবে খোঁজ নেয়া হয়েছে। এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে
বাংলামেইলকে বলেন, ‘কিমা তো সব মহিষের মাংস দিয়াই হয়। মহিষের মাংস ছাড়া অন্য মাংস দিয়ে কিমা বানানো
অনেক কঠিন কাজ।’
‘খবর নেই’ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের
হরহামেশা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে গরুর নামে মহিষের মাংস বিক্রি করা হলেও
এ বিষয়ে কোনো ‘খবর নেই’ জাতীয় সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। বিষয়টি সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যও তাদের
কাছে নেই। একইসঙ্গে এ বিষয়টি সিটি
করপোরেশনের দেখার দায়িত্ব বলেও দায় সেরেছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্তা।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিঞা বাংলামেইলকে
বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে কেউ কোনোদিন আমাদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেনি। কেউ অভিযোগ করলে সেটা আমরা খতিয়ে দেখতাম।’
তিনি আরো বলেন, ‘সিটি করপোরেশন গরু আর মহিষের মাংসের আলাদা দাম নির্ধারণ করে
দেয়ার পরে কোনো বিক্রেতা যদি তার চেয়ে বেশি মূল্য রাখে তাহলে সে বিষয়টি আমরা আমলে
নিবো। এছাড়া কোথায় গরু বা মহিষের
মাংস কোন নামে বিক্রি হয়, সে বিষয়ে খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।’
সীমাবদ্ধাতার দোহাই দিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন,
‘আমাদের কাছে এমন কোনো যন্ত্র নেই যে, জবাইয়ের
পরে কোনটা গরু বা কোনটা মহিষের মাংস সেটা প্রমাণ করা যাবে। কখনো কোনো ক্রেতা প্রমাণসহ এ নিয়ে অভিযোগ করলে
আমরা দেখবো।’
বাংলামেইল২৪ডটক/ এমএ/ এস
No comments:
Post a Comment